প্রকাশিত: Fri, Jan 6, 2023 4:20 PM
আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 9:01 AM

মেয়েদের স্ক্রিনশট প্রকাশের ‘রাজনীতি’

অর্জয়িতা রিয়া

মানুষ আগে শুধু অন্যের প্রাইভেসি লঙ্ঘন করত, এখন সেই লঙ্ঘন করাকে সবাই মিলা সেলিব্রেটও করে। অপরাধীর, অন্যায়কারীর স্ক্রিনশট যখন প্রকাশ করে কেউ, অন্যান্য ক্ষেত্রেও স্ক্রিনশট প্রকাশের সুযোগ তৈরি হয় তাতে। যেই কারণে এই প্রকাশ বা ফাঁসের অ্যাকশন অত্যন্ত সেনসিটিভ ও রিস্কি। ইদানীং কিছু মেয়েকে দেখি, কোনো ছেলে নক কইরা ছ্যাঁচড়ামি করলেই তার স্ক্রিনশট নিয়া পাবলিক কইরা দেয়। আমার বক্তব্য ছ্যাঁচড়ামির পক্ষে না। আপনি জিনিসটাকে কীভাবে হ্যান্ডেল করতেছেন একজন সোশ্যাল মিডিয়া ইউজার হিসেবে এবং তার ফল কী সেইদিকে আপনাকে মনোযোগ দিতে বলতেছি।

প্রথম প্রশ্ন, কেউ ছ্যাঁচড়ামি করতে পারবে কিনা? কোনো হ্যারেসমেন্ট না, ছ্যাঁচড়ামি। ধরেন: ফালতু জোক দিয়া মেয়ে পটাইতে চাওয়া, ফ্লার্ট করা, প্রশংসা করা, বারবার ম্যাসেজ পাঠানো ইত্যাদি। আপনার উত্তর যদি ‘না’ হয়, তাইলে আপনি দুইভাবে বিপদে পড়বেন। প্রথমটা হচ্ছে, নারী-পুরুষের স্বাভাবিক যে আকর্ষণ চক্র, আপনি তার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু আপনার এখনকার সমাজ তো এতো কনজারভেটিভ না। এমনকি আপনি নিজেও ফেসবুকে মানুষের প্রেম হওয়া, তথা ফেসবুকে প্রেমের প্রস্তাবের আদান প্রদানকে অ্যাপ্রুভ করেন। আপনার ক্ষেত্রে এই আদান প্রদান ঘটবে কিনা তা আপনার উপর নির্ভর করে। কিন্তু কেন কোনো পুরুষ আপনার সঙ্গে মিশতে চায়? হয় প্রেম, নাইলে সেক্স করার জন্য।

এই দুইটাই সোশ্যাল মিডিয়ার থ্রুতে ঘটে। আপনি তা জানেন। যদি অন্যদের ক্ষেত্রে হয় বইলা মাইনা নেন এবং তা স্বাভাবিক হিসেবে দেখেন, তাইলে ছ্যাঁচড়া ছেলেদের ম্যাসেজের স্ক্রিনশট আপনি কেন প্রকাশ করেন? ব্যক্তিগত রুচির কারণে? এইটা আপনার টাইপ না বা এই ধরনের ছেলে আপনার ভালো লাগে না, এরকম? তা ঠিক আছে, এমন রুচি থাকাতে সমস্যা নাই। কিন্তু জিনিসটা যদি শুধু আপনার রুচিগত হয়, আপনি ছ্যাঁচড়া ছেলেদের স্ক্রিনশট প্রকাশ করতেছেন কেন? কারণ হচ্ছে, আপনি কনজারভেটিভ। আপনি মনে করেন, আপনার রুচির না এমন ছেলেরা নিজে থেইকা আপনার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে। কে কী করবে, কার কাকে ভালো লাগবে তা কি আপনি ঠিক করবেন? ‘হ্যালো’ পাওয়ার পর তো আপনার হাতে অপশন থাকতেছেই কথা না বলার। রুচি মানে, ঠিক করা আছে আপনার, আপনি কোনটা নিবেন আর কোনটা না। এইক্ষেত্রে আপনার কাজ হবে তাকে ব্লক করা বা আনফ্রেন্ড করা।

কিন্তু বেশির ভাগ স্ক্রিনশটে দেখা যায়, মেয়েরা এই ‘ছ্যাঁচড়া’ ছেলেদের সঙ্গে কথা না বললেও স্ক্রিনশট দিচ্ছে, অনেকে স্ক্রিনশট প্রকাশের আগে দীর্ঘ আলাপও করতেছে। অর্থাৎ ছ্যাঁচড়া খুঁজতে গিয়া ও প্রমাণ করতে গিয়া এই মেয়েদের মধ্যে থাকা অ্যাকটিভিস্ট¯ছ্যাঁচড়া তৈরি করতেছে আসলে। সামাজিকভাবে একটা ছেলেকে ‘ছ্যাঁচড়া’ উপাধি দেয়াটা তাদের কাজ হয়ে পড়তেছে। আরো অবাক লাগে, নারীবাদীদের মধ্যে এই প্র্যাকটিস খুব কমন। নিজেরা নারীদের প্রেমের, সেক্সের প্রস্তাব দেওয়ায় বিশ্বাস করবে, কিন্তু কোনো পুরুষ নারীদের প্রস্তাব দিলে সেইটা তারা লাম্পট্য হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করে। অবশ্যই প্রস্তাব দেওয়া সংক্রান্ত ভদ্রতা আছে। তা কেউ মেইন্টেইন না করলে আপনি তাকে ব্লক করেন। কিন্তু সবাইকে ডাইকা একজন ‘পুরুষ’ এই কাজ করছে দেখানোটা সালিশি।

এই স্ক্রিনশট ফাঁসের আরেকটা কারণ, অন্যের রুচি ও ক্লাসকে ছোট কইরা দেখা। একটা ছোট ক্লাসের লোক, নিজের চেয়ে উঁচু ক্লাসের কাউকে প্রস্তাব দিচ্ছে প্রেমের, সেইটা আপনি নিতে পারেন না। তখন আপনি তাকে সামাজিকভাবে অপমান কইরা তার জায়গাটা তাকে দেখায়া দিতে চান। আর এই অপমানের বর্তমান জনপ্রিয় পদ্ধতি হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া সালিশি। স্ক্রিনশট প্রকাশ করা সেই সালিশির অংশ।

অনেকগুলা নেগেটিভ পরিবর্তন ঘটে এই জিনিসটার কারণে। প্রথমত ওই ‘ছ্যাঁচড়া’ লোকটার প্রাইভেসি ও সামাজিক জীবন নষ্ট হয়। তার জন্য প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার সঠিক ক্লাস নির্ধারিত হয় এই অ্যাক্টের মাধ্যমে। তাকে চোখে দিয়া দেখানো হয়, সে নিজের চাইতে ওপরের ক্লাসের কালচারড মেয়েদের দিকে চোখ তুইলা তাকাইতে গেছিল, তার ফল সে পাইছে। একটা ভুয়া কারণের জাস্টিস আদায়ের অনুষ্ঠানে নতুন কইরা শ্রেণিবৈষম্য সমাজে প্রতিষ্ঠা পায়। এখন ক্লাসভিত্তিক প্রেম পিরিতি কি সমাজের জন্য ক্ষতিকর? না, ক্ষতিকর না। যতক্ষণ না আপনি নিচের ক্লাসের কাউকে গিয়া বলতেছেন বা শো করতেছেন, তুই ছোট ক্লাসের বইলা আমার সঙ্গে মিশতে পারবি না।

বর্ণবাদ একটু ট্রিকি। আপনার চেতনায় ছোট ক্লাস বর্জন করার যে সচেতনতা আছে, তা বর্ণবাদ অবশ্যই, কিন্তু ক্ষতিকর না। ক্ষতিটা ঘটে, যখন সেইটা প্রকাশ করতে যান। তখন সমাজে আপার ক্লাস শাসকরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং গরিবরা হয় চাকর। নিজের মধ্যে যখন রাখেন, আপার ও লোয়ার ক্লাস নিজেদের মতো যার যার জায়গায় কেউ কাউকে ছোট বা অপমান না কইরাই বসবাস করতে পারে। দ্বিতীয়ত, এই যুগে আইসা একজন ‘শিক্ষিত’ সচেতন নাগরিক হইয়াও আপনি সালিশ বসান। তৃতীয়ত, একটা জটিল কনজারভেটিভ কমিউনিটি আপনি তৈরি করেন।

চতুর্থত এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর কাজ, চাইলেই যেকারো স্ক্রিনশট প্রকাশ করাকে আপনি অ্যাপ্রুভ করেন। যে আপনাকে অ্যাবিউজ করতেছে তার স্ক্রিনশট প্রকাশ করা, আর যিনি অ্যাবিউজার না, শুধু আপনার ক্লাস অনুসারে অ্যাক্ট করতে জানে না বা প্রস্তাব দেওয়ার নর্মসগুলো জানে না বা আপনার রুচির সঙ্গে যায় নাÑএমন কারো স্ক্রিনশট প্রকাশ করা এক জিনিস না। স্ক্রিনশট প্রকাশের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে কাউকে অ্যাবিউজার বানানোর সুযোগ তৈরি হয়। নারীরা যদি ফেসবুকে প্রেমের প্রস্তার দিতে পারে, ফ্লার্ট করতে পারে, সেক্সের প্রস্তাব দিতে পারে, পুরুষরা কেন পারবে না? ফেসবুক অবশ্যই নারী পুরুষের মধ্যে যোগাযোগ ঘটার একটা মাধ্যমে, এই মাধ্যমকে আপনি কেন বন্ধ করতে চান? এর মাধ্যমে কি নারীদের প্রস্তাব দেওয়ার পথটাও আপনি বন্ধ করতেছেন না?

যেই পক্ষ প্রস্তাব দেয় সে কীভাবে এবং কোন সময়ে প্রস্তাবটা দিচ্ছে তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ। কেউ আপনাকে পরিচিতি ও সম্পর্কের একটা পর্যায়ে প্রস্তাব দিলে তা ঠিক আছে। যেইটা স্বাভাবিকভাবে ঘটে। কিন্তু সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব ছাড়া হঠাৎ আইসা কেউ আপনাকে যৌন প্রস্তাব দিলে তাকে আপনি অ্যাবিউজ বলতে পারবেন। যেমন ধরেন, প্রথম ম্যাসেজটাই কেউ দিলো তার ডিকের ছবি পাঠায়া, আপনাকে জিজ্ঞেস করলো, চলবে নাকি? এইটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফেসবুক থেকে